স্বদেশ ডেস্ক::
যেখানে দল-মত, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের বিভেদ নেই; নেই অহমিকার বালাই। এত বড় মজমা, অথচ কোথাও কোনো শোরগোল নেই। ঝগড়া-বিবাদ পরের কথা, কেউ কর্কশ স্বরে কথা বলেছেন, এমন দৃশ্যও চোখে পড়ে না। বরং ‘মুসলমান ভাই ভাই’ বাণীতে উজ্জীবিত হয়ে পরস্পর পরস্পরের মাঝে গড়ে তুলেন মানবতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, শৃঙ্খলা, ধৈর্য, ঐক্য আর মায়া-মমতার এক আত্মিক বন্ধন।
অতুলনীয় এ তীর্থস্থানে ‘এ্যাই মুসলমানো, তুম মুসলমান বনো’ আহ্বানে জড়ো হন সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমান। জন্মসূত্রে মুসলমান হয়েও ধর্মে যারা উদাসীন, দুনিয়ার চাকচিক্য, লোভ-লালসা আর প্রতিহিংসার দাবানলে পুড়ে আত্মাকে করেছে অঙ্গার, তারাও আত্মাকে পুণ্যের বারিধারায় সিক্ত করতে শরিক হন ইজতেমায়। নিবিষ্ট হন আরাধনায়।
আলেমদের মুখে আল্লাহর বিধান ও রাসূলের বাণী হৃদয়ঙ্গম করে ঘরে ফেরেন ইসলাম নির্দেশিত পথে জীবন নির্বাহের দীক্ষা নিয়ে। আবার অনেকেই আল্লাহতায়ালার শাশ্বতবাণী, ‘আর তারচেয়ে কার কথা উত্তম, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’- আয়াতটি হৃদয়ে ধারণ করে দাওয়াতের মশাল নিয়ে ছড়িয়ে পড়েন দেশ থেকে দেশান্তর।
পুণ্যময় এ সম্মেলনটি হচ্ছে আমাদের, শিল্পনগরী টঙ্গীর ঐতিহ্যময়ী তুরাগ নদীর তীরে। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। কেননা এ ইজতেমাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেমন বাংলাদেশের ধর্মীয় ইমেজ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনই বিশ্বের শতাধিক দেশ থেকে ইজতেমায় অংশগ্রহণ করতে আসা মুসল্লিদের আর্থিক লেনদেনে সমৃদ্ধ হচ্ছে আমাদের অর্থভাণ্ডার। এছাড়াও বিশ্বমিডিয়ার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে আমাদের আতিথেয়তা, বন্ধুপ্রীতির যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে, তাতে পুরো বিশ্বেই আমাদের ভাবমূর্তি হয়েছে উজ্জ্বল। তাই বলতে দ্বিধা নেই, ইজতেমা আমাদের গর্ব।
কিন্তু আফসোসের কথা, অহিংসা, আমিত্ব আর দীনের জন্য নিজেকে মিটিয়ে দেয়ার এ বিপ্লবী মিশনেও ভাঙন ধরেছে আজ। গত দুইবছর যাবত এ বিভক্তি চলছে। সেই বিভক্তিই এখন মহা আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মুসল্লিদের কাছে। হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্ব দরবারে অর্জিত বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। তাই এখন এ বিভক্তির যবনিকা টানা দরকার। নতুবা অচিরেই আমাদের গর্ব, বিশ্ব ইজতেমা হাতছাড়া হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের কাছেও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে আমাদের।
তাই দীনের এ মেহনতকে জারি রাখতে, দেশের সুনাম বজায় রাখতে আমরা আবারও এক হই। ভুলে যাই সব বিরোধ। যেভাবে হজের সময় এলে সব বিরোধ ভুলে যেত জাহেলি যুগের কাফেররাও। বছরের পর বছর, বংশপরম্পর রক্তারক্তিও থামিয়ে দিতেন। এ থামিয়ে দেয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে মক্কার সম্মান। হজে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা লোকজনের কাছে যেন মক্কার চিত্র ন্যক্কারজনক না হয়ে উঠে, সেজন্য তারা শত্রুর সঙ্গেও গলাগলি করতে দ্বিধা করত না। পবিত্র হাদিসেও এমনই কথা বলা হয়েছে … ‘পূর্বকাল থেকেই বাইতুল্লাহর প্রাঙ্গণ নিরাপদ ও সম্মানিত। বর্বরতার অন্ধকার যুগেও বাইতুল্লাহর সীমানায় শত্রুকে হাতের নাগালে পেয়েও হত্যা তথা প্রতিশোধ গ্রহণ করত না। কেয়ামতকাল পর্যন্ত নিরাপত্তা ও সম্মানের এ ধারা চলমান থাকবে…।’ (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত)
সুতরাং আমাদের আলেম-ওলামা, আমির, মুরব্বি, তাবলিগের সাথী ভাইদেরও কি উচিত নয়, দীনের স্বার্থে, ইজতেমাকে সফল করার লক্ষ্যে, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সুনাম ধরে রাখতে নিবেদিত প্রাণ হওয়ার? জাহেলি যুগের কাফেররা যদি মক্কার পবিত্রতা রক্ষায়, দেশের সুনাম বজায় রাখার ব্যাপারে বংশক্রম যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারে, তাহলে তাবলিগে এ তিন দিন, এক চিল্লা, তিন চিল্লা এক সাল মেহনত করেও আমরা কেন পারব না এক হতে?
‘আল্লাহই ভালো জানেন, কে তাঁর পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হেদায়াতপ্রাপ্তদেরও তিনি খুব ভালো করেই জানেন।’ (সূরা নাহল : ১২৬) তাই অনুরোধ, ইজতেমার মতো দীনের বৃহত্তম স্বার্থে আর হাঙ্গামা না করি। এখানেই ইজতেমা থেকে খামোশ হয়ে যাই।লেখক : প্রাবন্ধিক
আজকের স্বদেশ/জুয়েল
Leave a Reply