আন্তর্জাতিক ডেস্ক::
কিয়েভ শহরের একপ্রান্তে বিশাল এলাকাজুড়ে ‘গ্রেট প্যাট্রিওটিক ওয়্যার’ জাদুঘর। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিস্মারক নিয়ে এই জাদুঘর। এর সামনের চত্বরে ‘জন্মভূমি’ নামক এক অতিকায় ভাস্কর্য। মূল সড়ক থেকে সেই ভাস্কর্যের বলিষ্ঠ হাতে ধরা স্টিলের তলোয়ারের দিকে মুখ করে হাঁটলে কংক্রিটে বাঁধাই আরেকটি চত্বর সামনে আসে।
সেখানে আজকাল শোভা পায় টায়ার হারানো কয়েকটি আরমার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার, বোমার স্পিনটারে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া সিভিলিয়ান অ্যাম্বুলেন্স কিংবা রকেট-লঞ্চার ট্রাক। বিএমডি-২ মডেলের তেমন একটি যানের সামনে লেখা রয়েছে, ‘২০১৪ সালে পূর্ব ইউক্রেনের সংঘাতপূর্ণ এলাকা থেকে এই যানটি আটক করা হয়। এর মডেল নম্বর এবং গায়ে আঁকা চিহ্ন দেখে পরিষ্কার, এটি রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ব্যবহৃত যান। এরপরও কি রাশিয়া বলবে, তারা পূর্বাঞ্চলের সহিংসতায় সরাসরি মদদদাতা নয়?’
শুধু এই চত্বর-ই নয়, পূর্বাঞ্চলে চলতে থাকা যুদ্ধের ছায়া পড়েছে যেন কিয়েভজুড়েই। গত আগস্ট মাসে কিয়েভে গিয়ে অন্তত তেমনটাই চোখে পড়ল। সেইন্ট মিখাইল চার্চে গিয়ে দেখি, সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে যুদ্ধে নিহত শহীদদের নানা ব্যবহার্য সামগ্রী।
সেসব দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন সদ্য-নিহত টগবগে সেনাদের মা, বোন কিংবা স্ত্রী। ভালোবেসে কেউবা জ্বালিয়ে দিচ্ছেন মোমবাতি, আবার কেউবা তর্পণ করছেন একগোছা ফুল। এই স্মরণসভা, শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন দেখে মনে হতে পারে ২০১৪ সালে শুরু হওয়া যুদ্ধ বুঝিবা শেষ কিংবা স্তিমিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু আসলেই কি তাই? নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে কির্চ প্রণালিতে যে প্রক্রিয়ায় রাশিয়া ইউক্রেনের তিনটি সামরিক জাহাজকে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আটক করে, তা দেখে মনে হয় এ দু’দেশের মাঝে চলমান ছায়াযুদ্ধ হয়তো অচিরেই থামছে না।
শুরুটা হয়েছিল ২০১৩ সালে। রুশ মদদপুষ্ট প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে সখ্য বাড়ানোর বিষয়ে বেঁকে বসলে উত্তাল হয়ে ওঠে কিয়েভ। তরুণ জনতা চায় রাশিয়ার বদলে ইউরোপের সঙ্গে প্রগাঢ় মৈত্রীবন্ধন। শহরের কেন্দ্র মায়দান স্কয়ারে জড়ো হয় হাজারো জনতা; যেটি এক সময় উত্তাল বিক্ষোভে রূপ নেয়। বেশকিছু হতাহতের পর জয় হয় জনতার।
দুর্নীতিবাজ ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে যান। প্রেসিডেন্ট হন পোরোশেঙ্ক। ফলে ইউক্রেনের সঙ্গে পশ্চিমের সখ্য বাড়ার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়, সম্ভাবনা তৈরি হয় ন্যাটোতে যোগদানের। সঙ্গত কারণেই সেটি বিচলিত করে তোলে রাশিয়াকে। ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগদানের ফলাফল হল ইউক্রেন-রাশিয়ার বিস্তৃত সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে মার্কিন হামভি যানের ভবিষ্যৎ উপস্থিতি। আর এসব মাথায় রেখেই সে বছর রাশিয়া কৌশলে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়। উদ্দেশ্য, অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করে ইউক্রেনকে রাশিয়ার প্রভাব-বলয়ে আটকে রাখা। সেই খেলার ধারাবাহিকতাতেই নতুন করে ঝামেলা তৈরি হয় পূর্ব ইউক্রেনের দোনবাস ও দোনেৎস্ক অঞ্চলে।
ওই অঞ্চলটিতে বসবাসকারীদের অধিকাংশই জাতিগতভাবে রুশ। এবার রাশিয়া এদের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদের সহিংস আন্দোলনকে উসকে দিল। এমনকি গেরিলা যোদ্ধাদের মাঝে ঢুকিয়ে দেয় নিজেদের সেনা আর সামরিক রসদও। সেই বলে বলীয়ান হয়ে পূর্বাঞ্চলের যোদ্ধারা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে গত চার বছর ধরেই। এর মধ্যেই হতাহতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। আর বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লাখে। এদের একটা বড় অংশ এসে আশ্রয় নিয়েছে কিয়েভ শহরে। এ নিয়ে রাজধানীর বাকি বাসিন্দারা খুব একটা প্রীত নয়।
যাক, সে এক ভিন্ন গল্প। যুদ্ধের প্রসঙ্গে ফিরে গেলে বলতে হয়, ২০১৫ সালে বেলারুশের মিন্সক শহরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় যুদ্ধাবস্থা প্রশমনের লক্ষ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মাঝে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তার ফল হয়েছে লবডঙ্কা। রাশিয়া এখনও সেই আগ্রাসী ভূমিকাতেই আছে। অন্যদিকে ইউক্রেন সংক্রান্ত বিষয়ে রাশিয়াকে চাপ দিয়ে বাগে আনতে আন্তর্জাতিক মহলও অনেকটাই যেন ব্যর্থ। কেনই বা তারা ব্যর্থ? এ নিয়েই না হয় কিছুটা আলোচনা করা যাক।
ক্রিমিয়া দখলের পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। তবে অনেকটা একই সময়ে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়া নিজের একটি জোরালো অবস্থান নতুন করে খুঁজে পায়। পরবর্তী কয়েক বছরে আমেরিকা ও বাদবাকি শক্তিশালী দেশগুলোকে ব্যস্ত থাকতে হয় আইসিসি, লাখো শরণার্থীর পুনর্বাসন ইত্যাদি নানা সমস্যায়। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য সংকট মোকাবেলায় ইউক্রেনকে কিছু সামরিক সাহায্য দেয়, কিন্তু সেটি কোনো বৃহৎ পরিসরে নয়। ওদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের অর্থনৈতিক লেনদেন আমেরিকার চেয়ে বেশি হলেও তাদের পক্ষ থেকে অবরোধের ব্যাপারে খুব একটা জোর প্রয়াস লক্ষ করা যায়নি। সদস্য দেশগুলো ব্যবসা হারানোর ভয়ে এ নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হতে নারাজ।
এবার ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নজর দেয়া যাক। পোরোশেঙ্ক ক্ষমতায় এলে অনেকে ভেবেছিল, দুর্নীতিমুক্ত নতুন সরকার ঢেলে সাজানো হবে। বৃথা সে আশা। সাবেক চকলেট ব্যবসায়ী এই প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে কিয়েভের একজন মজা করে বলছিলেন, ভেবেছিলাম তিনি ক্ষমতায় এলে চকলেটটা অন্তত কম দামে খেতে পারব, উল্টো ওটার দামও গেছে বেড়ে। সর্বগ্রাসী দুর্নীতিকে ধামাচাপা দিয়ে জনগণের নজর ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে পোরোশেঙ্কও যুদ্ধই চান। যাতে করে জাতীয়তাবাদ উসকে দিয়ে মানুষকে বুঁদ করে রাখা যায়।
আগস্টে দেখলাম, প্রায় পাঁচ দিন ধরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মহড়া করে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হল। প্রেসিডেন্ট গা-গরম করা বক্তব্য দিলেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ভেতরের উদ্দেশ্য বুঝতে বিজ্ঞজন হওয়ার প্রয়োজন নেই। আগামী মার্চ মাসে নির্বাচন। জনমত জরিপে প্রেসিডেন্টের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে বলে দেখা যাচ্ছে। কাজেই এখন কামান-ট্যাংকের মহড়া করে তিনি হয়তো বোঝাতে চাইছেন, তাকে ভোট না দিলে রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকানো যাবে না।
প্রশ্ন হল, পুতিন তাহলে এমন এক সময়ে ইউক্রেনের যুদ্ধজাহাজ আটক করলেন কেন? ওতে তো তার দুশমন পোরোশেঙ্কর হাত বলিষ্ঠ হবে। নিজ দেশে সমর্থন বাড়বে (পোরোশেঙ্ক ইতিমধ্যে মার্শাল ল’ জারি করে দিয়েছেন, সেটি হয়তো তাকে নির্বাচনে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে ছাড়বে)। বর্তমান প্রেক্ষাপট ঝালিয়ে দেখলে এর কারণ কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে। পুতিন চান ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরগুলোকে একেবারে পঙ্গু করে দিতে। যাতে করে ওদিকটায় ইউক্রেনের নৌবাহিনীর সক্ষমতা না থাকে; আজভ সাগর থেকে লোহিত সাগরে তাদের সমরপোতগুলোর চলাচল হয় সীমিত।
আর সেই বার্তাটা দেয়ার এটাই হয়তো মোক্ষম সময়। কারণ আমেরিকায় মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বেশ চাপের মাঝে আছেন। ওদিকে জার্মানির মারকেল পার করছেন পাথর সময়। চলতি ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় পার্টি নির্বাচনে তার নেতৃত্ব হারানোর আশঙ্কা প্রবল। রাশিয়া থেকে জার্মানি অবধি টেনে আনা নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাসলাইনের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে, যেটির মাধ্যমে রাশিয়া আগামীতে জার্মানির চাহিদার প্রায় ৫০ ভাগ গ্যাস জোগান দেবে। জার্মানির হাত তাই অনেকটাই বাঁধা।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে জনরোষের মুখে। প্যারিস তেতে আছে সাধারণ মানুষের মিছিলে। তিনিও তাই গৃহদাহ নির্বাপণ করতেই বেশি ব্যস্ত। আর ব্রিটেন? নিকট অতীতে রাশিয়ার নানা অপকর্মের সাক্ষী হলেও এবারে তাদের বেশি মাথাব্যথা ব্রেক্সিট নিয়ে। ইউক্রেন সংকট নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক বিবাদে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এ মুহূর্তে থেরেসা মে সরকারের নেই।
দুর্ভাগ্যটা শেষ অবধি ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের। মুদ্রাস্ফীতি এ মুহূর্তে আকাশচুম্বী। বেকারত্ব প্রবল। ওদিকে স্বদেশে একের পর এক আসছে দুর্নীতিবাজ সরকার। দেশের প্রকৃত ক্ষমতা মূলত কোটিপতি কিছু ব্যবসায়ীর হাতে কুক্ষিগত। সাধারণ মানুষ ভেবেছিল, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অংশ হলে দুর্নীতিবিরোধী পরিকাঠামো তৈরি হবে। বিনিয়োগ বাড়বে, বাড়বে কর্মসংস্থান। কিন্তু রাশিয়ার ক্রমাগত আগ্রাসী তৎপরতায় সেই সম্ভাবনা এখন অনেকটাই ফিকে। তবে মনে রাখতে হবে, ইউক্রেনে রাশিয়া এভাবে ক্রমাগত বিজয়ী হলে সাবেক সোভিয়েত বলয়ভুক্ত অপরাপর দেশগুলোও একসময় নিজেদের পিঠ বাঁচাতে পারবে না। রাশিয়ার তপ্ত নিঃশ্বাস তখন তাদেরকেও তাড়া করে ফিরবে।
তেমন একটি সময়ে যাওয়ার আগেই তাই আমেরিকা চাইবে ইউরোপিয়ান মিত্রদের নিয়ে একটি অভিন্ন কৌশল প্রণয়ন করা, ইউক্রেনকে সক্রিয় সামরিক ও কূটনৈতিক সাহায্য বলবৎ রাখা, প্রয়োজনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় পূর্বাঞ্চলে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা করা। এ সবকিছুর সঙ্গে প্রভাবশালী দেশগুলো যদি ইউক্রেনের সরকারের ওপর দুর্নীতি নির্মূলে কার্যকর চাপ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে, তবেই ইউক্রেনবাসীর দীর্ঘমেয়াদি মঙ্গল হবে, নতুবা নয়।
সঞ্জয় দে : যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া প্রবাসী
ankaneee@gmail.com
আজকের স্বদেশ/জুয়েল
Leave a Reply